রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আলোচনায় জনগণ নেই

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ প্রায় আট মাস হতে চলল। কিন্তু এখনো রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঠিক স্বস্তিদায়ক বলে মনে হচ্ছে না। রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে এই অস্বস্তি কেন?

হোসেন জিল্লুর রহমান: রাজনৈতিক পরিস্থিতির মূল্যায়ন করতে হলে কয়েকটি দিক বিবেচনায় রাখতে হবে। সামষ্টিক অর্থনীতির বেশ কিছু সূচকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার স্থিতিশীলতা আনতে সক্ষম হয়েছে, যদিও বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান-খরা চলছেই। রমজান মাসটাও তুলনামূলকভাবে স্বস্তিতে কেটেছে।

কিন্তু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রশ্নটি ভিন্ন। এখানে নিয়ামক একটি বিষয় হচ্ছে সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রোডম্যাপ। সেই রোডম্যাপ আছে কি না এবং থাকলে সেটা নিয়ে সবার একটি স্বচ্ছ ধারণা ও আস্থা আছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সরকারের নিয়তটাই-বা কী এবং তা দৃশ্যমান ও সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হচ্ছে কি না, এটিও একটি বিবেচ্য বিষয়।


রোডম্যাপ নিয়ে দু-তিনটি ইস্যু আছে। একটি হচ্ছে নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ। আরেকটি ইস্যু হলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে যে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে যে বিভিন্ন গোষ্ঠী রয়েছে, তাদের আসলে আকাঙ্ক্ষাটা কী? নির্বাচন নিয়ে নানা ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যাচ্ছে—কেউ (নির্বাচন) আগে চায়, কেউ দেরিতে চায়। কারও কারও ধারণা, কোনো একটি নির্দিষ্ট গ্রুপের প্রয়োজনে নির্বাচনের তারিখ পেছানোর কথাবার্তা উঠছে। এসব বিবিধ কারণে একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ার মূল কারণ খুবই স্বচ্ছ ও জোরালো একটি রোডম্যাপ না থাকা। ফলে বেশ কিছু বিতর্ক তৈরি হয়েছে।


এ রকম একটি বিতর্ক হচ্ছে সংস্কার বনাম নির্বাচন। আরেকটি বিতর্ক হচ্ছে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে, নাকি জাতীয় নির্বাচন আগে। রোডম্যাপ শুধু একটি টেকনিক্যাল বিষয় নয়, এটি রাজনৈতিক বিষয়ও বটে। তাই সরকারের তরফ থেকে একতরফা একটি রোডম্যাপ চাপিয়ে দেওয়াও কাজের কাজ হবে না।


রোডম্যাপের জন্য কি রাজনৈতিক ঐকমত্যের প্রয়োজন হবে না?

হোসেন জিল্লুর রহমান: ইদানীং ঐকমত্য শব্দটা বেশ চালু হয়েছে। কিন্তু ঐকমত্যের প্রয়োজনীয় জায়গা বা বিষয়গুলো সেই অর্থে স্পষ্ট হয়নি। ঐক্য তৈরির প্রচেষ্টার মধ্যেও নানামুখী ঘাটতি দেখতে পাচ্ছি। ঐকমত্য তৈরির কাজটাকে একটি চলমান রাজনৈতিক প্রচেষ্টা হিসেবেও দেখা দরকার। কারণ, এখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠী ও মহল আছে। নতুন প্রতিযোগীও আবির্ভূত হয়েছে। সবার আকাঙ্ক্ষাকে স্বচ্ছ বোঝাপড়ার মাধ্যমে একটি জায়গায় নিয়ে আসা প্রয়োজন।

এ ক্ষেত্রে আমার অবজারভেশন হলো ঐকমত্য তৈরির বিষয়টিকে খুবই আমলাতান্ত্রিকভাবে দেখা হচ্ছে। ঐকমত্য তৈরি আমলাতান্ত্রিক নয়, একটি রাজনৈতিক বিষয়। এ ক্ষেত্রে আস্থা তৈরি করার বিষয় আছে। রাজনৈতিকভাবে ঐকমত্য তৈরির কথা যদি বলি, এটা ধরে নিতে হবে রাজনীতির মাঠে বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগী আছে, তাদের নানা ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি ও চাহিদা আছে, কিন্তু এগুলোর চেয়েও বৃহত্তর একটি বিষয় রয়েছে। সেটি হলো দেশটাকে মানে দেশের স্বার্থ-উন্নয়ন-অগ্রগতিকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রাখা।


এই যে গত ১৫-১৬ বছর আমরা গণতন্ত্রের ভয়াবহ পশ্চাদপসরণ দেখেছি, স্বৈরাচারী শাসনকাঠামোর চূড়ান্ত প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ দেখেছি, আমরা সেখান থেকে উত্তরণের একটি সুযোগ পেয়েছি। এখন আবার খুবই পরিবর্তনশীল একটি ভূরাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত দেখা যাচ্ছে। এ রকম অবস্থায় আমাদের কিছু মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্য লাগবেই। যতই প্রতিযোগিতা থাকুক, নিজস্ব চাহিদা ও দৃষ্টিভঙ্গি থাকুক—এগুলোর ঊর্ধ্বে সবাইকে এক জায়গায় আনার একটি বিষয় আছে, বাংলাদেশের বৃহত্তর যে স্বার্থ, সেগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত করার প্রয়োজন আছে।

সম্পর্কিত খবর :